৪৭১ থেকে ৫৬১ হিজরির সেই বিভ্রান্তিকর যুগে মুসলমানদের মধ্যে যখন শিরক, কুফর, বিদআত ও কুসংস্কারের বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছিল—যখন মানুষ ইসলামের প্রকৃত চেতনা থেকে সরে গিয়ে জাগতিক মোহে নিমজ্জিত হচ্ছিল—তখনই মহান আল্লাহর কৃপায় আবির্ভূত হন গাউসুল আজম (রহ.)। তিনি নবউদ্যমে ইসলামের আলো জ্বালিয়ে সমাজকে ফিরিয়ে আনেন ঈমান, নৈতিকতা ও আত্মশুদ্ধির পথে। এজন্যই ইতিহাস তাঁকে দিয়েছে এক অনন্য উপাধি—‘মুহিউদ্দীন’, অর্থাৎ দ্বীনের পুনর্জীবনদাতা।
গাউস পাক (রহ.)-এর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও আধ্যাত্মিক তেজ কেবল তার যুগের নয়, বরং সব যুগের মুসলমানের জন্য শিক্ষণীয়। তাঁর রচিত অসংখ্য কিতাব—বিশেষত তাফসির ও আধ্যাত্মিক তত্ত্বসংবলিত গ্রন্থগুলো—আজও পথহারা উম্মতের দিশারী হিসেবে কাজ করছে। তাঁর চিন্তার গভীরতা, ভাষার সৌন্দর্য এবং দীনপ্রেম আজও প্রতিটি ঈমানদারের হৃদয়ে আলো ছড়ায়।
গাউসুল আজমের জীবনের শিক্ষা
বড়পীর (রহ.) ছোটবেলাতেই পিতৃহারা হন। কিন্তু মাতা উম্মুল খায়ের ফাতেমা (রহ.)-এর অনুমতি নিয়ে তিনি জিলান থেকে বাগদাদে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য গমন করেন। সেখানে শুরু হয় কঠোর আত্মসংযম ও সাধনার এক দীর্ঘ অধ্যায়। জীবনের কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন—
“আমি এমন বিপদের মুখোমুখি হয়েছি, যা যদি কোনো পাহাড়ের ওপর নেমে আসত, তবে পাহাড় দ্বিখণ্ডিত হয়ে যেত। তখন আমি কুরআনের এই আয়াত পাঠ করতাম— ‘নিশ্চয়ই কষ্টের পরই সুখ আছে।’”
এই এক বাক্যে ফুটে ওঠে তাঁর ধৈর্য, আল্লাহভীতি ও অবিচল ঈমান। গাউসুল আজম (রহ.) শেখান—সত্যিকারের মুসলমান কষ্টে ভেঙে পড়ে না, বরং আল্লাহর রহমতের আশায় দৃঢ় থাকে।
নবজাগরণের প্রতীক
হজরত আলী (রা.)-এর শাহাদতের পর যে আধ্যাত্মিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল, দীর্ঘ সাতশত বছর পর গাউসুল আজম (রহ.)-এর আবির্ভাবে তা পূরণ হয়। তিনি সমাজ থেকে বিদআত, কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূর করে কুরআন–সুন্নাহভিত্তিক ইসলামের শুদ্ধ রূপ প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে মুসলিম উম্মাহর মাঝে আবার জেগে ওঠে নবজাগরণের স্ফুলিঙ্গ।
তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিশ্ব মুসলমান প্রতি বছর চান্দ্রমাসের ১১ রবিউস সানিতে পালন করে ‘ফাতিহা-ই-ইয়াজদহম’—যা এক আধ্যাত্মিক ঐক্য ও আত্মশুদ্ধির প্রতীক দিবস।
সাহিত্য ও প্রেমের সাধক
গাউস পাক (রহ.) কেবল একজন পীর বা সুফি নন, তিনি ছিলেন এক প্রাজ্ঞ সাহিত্যিক ও প্রেমের কবি। তাঁর কাসিদাতুল গাউসিয়া ইসলামি আধ্যাত্মিক সাহিত্যের এক কালজয়ী সৃষ্টি। তাঁর রচিত “আসমায়ে গাউসিয়া”-এর আটটি কবিতা আজও আল্লাহপ্রেমিকদের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়—যা প্রেম ও নিষ্ঠার দোয়া হিসেবে ওজিফায় পরিণত হয়েছে।
আজকের দুনিয়ার জন্য বার্তা
আজ যখন গোটা দুনিয়ায় মুসলমানরা নানা বিভাজন, অশান্তি ও ষড়যন্ত্রে নিপতিত—তখন বড়পীর (রহ.)-এর আদর্শই পারে আমাদের ঐক্যবদ্ধ করতে। তাঁর শিক্ষা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—ঐক্য, ধৈর্য, আল্লাহভীতি ও আত্মশুদ্ধিই ইসলামের প্রকৃত রূপ।
মুসলমানদের উচিত আজ আবারও সেই নবজাগরণের আহ্বানে সাড়া দেওয়া—সত্য, ত্যাগ ও প্রেমের যে আলো গাউসুল আজম (রহ.) জ্বালিয়েছিলেন, তা নিজেদের জীবনে ধারণ করা। তাহলেই পুনরায় জেগে উঠবে ইসলামের আলোকিত দিগন্ত।
সভাপতি, জকিগঞ্জ উপজেলা প্রেসক্লাব
